ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতা আমির হোসেন আমুর ”পালিত পুত্র” এবং খুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও গণপূর্ত অধিদপ্তর,বরিশাল-এর নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়সাল আলম রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও দাপটের সাথে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। ঝালকাঠির রাজাপুরের সন্তান ফয়সাল আলম আওয়ামী শাসনামলে আমুর ”পালিত পুত্র” পরিচয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আওয়ামী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকায় বদলি,পদোন্নতি,নিয়োগ,টেন্ডার সিন্ডিকেট সবই ছিল তার হাতের মুঠোয়। এখন ভোল পাল্টে পূর্বের ন্যায় দুর্নীতির সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট।
সূত্রমতে, প্রথমে ঝালকাঠি, পরে বরিশাল—দুই জায়গাতেই নির্বাহী প্রকৌশলীর চেয়ার দখল করেন ফয়সাল। দায়িত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় পরোক্ষ ঠিকাদারি ব্যবসা, টেন্ডারবাজি আর ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের পালা। পালিত বাবা আমুর নির্বাচনী কাজে অর্থ ঢেলেছেন, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের নৌকা প্রতীকের নির্বাচনী প্রচারণায় টাকা খরচ করেছেন। এমনকি স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমাতেও অর্থ ব্যয় করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ঝালকাঠির দায়িত্বে থাকা কালে ফয়সাল আলম দুর্নীতির বরপূত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এলটিএম টেন্ডারে ব্যাপক জালিয়াতি, সদর মডেল মসজিদ, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, ২৫০ শয্যার হাসপাতাল, এনএসআই ভবন, পুলিশ লাইনের মেস—সব জায়গাতেই দুর্নীতি তার ছাপ রেখে যায়। কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ থাকলেও আমুর ছায়াতলে থাকায় দুদকে দায়েরকৃত অভিযোগও হাওয়া হয়ে গেছে।
জানাগেছে, গত বছরের ৫ আগস্টে ছাত্র জনতার আন্দোলন সংগ্রামের ফলে সাবেক আওয়ামী লীগের দোসর আমির হোসেন আমুর পতনের পরেও টিকে থাকতে তিনি আওয়ামী পরিচয় গোপন করে “বিএনপিপন্থী” কর্মকর্তা সাজেন। অবৈধ অর্থের জোরে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইইবি বরিশাল কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান পদে আসীন হন।
বরিশালে এসে ফয়সাল গড়ে তোলেন ভয়ঙ্কর এক লুটেরা সিন্ডিকেট। খান বিল্ডার্স, খান ট্রেডার্স, বাবর অ্যাসোসিয়েটস, এসএ এন্টারপ্রাইজসহ একঝাঁক প্রতিষ্ঠান তার ছত্রছায়ায় কোটি কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেয়। শেবাচিম ক্যান্সার ইউনিটের কাজ দুই দফা বাড়িয়ে ২৩৯ কোটি টাকার প্রকল্পে ৯৯ কোটি টাকায় ভবন নির্মাণের পাশাপাশি কোটি কোটি টাকার মালামাল সরবরাহ দেখিয়ে পুরো বিল আদায় করা হয়—কিন্তু মালামাল সাইটে বসানোর জায়গাই নেই! একইভাবে বরিশাল নভোথিয়েটারের অর্ধেক ভবনও শেষ হয়নি, অথচ কোটি কোটি টাকার বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, সাউন্ড সিস্টেম, জেনারেটর, এসি সরবরাহ দেখিয়ে বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর কর্তৃপক্ষ তার বদলির আদেশ দেয়, কিন্তু পরিবহন ব্যাবসায়ী ও বরিশালের শক্তিশালী ঠিকাদার মিজান খান (কাশি মিজান) ও নাসির খান ম্যানেজ করে তাকে বহাল রাখে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানাগেছে, শেবাচিম হাসপাতালে ক্যান্সার ইউনিট নির্মাণে দুই দফা ব্যয় বাড়িয়ে বরাদ্দ হয় ২৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৯ কোটি ৪১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা চুক্তিমূল্যে বেজমেন্টসহ ১৫তলা ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। প্রকৌশলী ফয়সাল আলমের গোপন ব্যবসায়িক পার্টনার খান বিল্ডার্স নামক প্রতিষ্ঠানটি এ কাজের বাস্তবায়নে রয়েছে।
ভবন নির্মাণ পুরোপুরি শেষ না হলেও ২০৩৪-২৪ অর্থবছরে ৪,৮৪,১০,৫০৮ টাকা চুক্তিমূল্যে ওই ভবনের জন্য পিবিএক্স সিএটিভি/ডিস পিএ সিস্টেম ডিজিটাল কনফারেন্স সিস্টেম সোলার সিস্টেম পিএবিএক্স সিসিটিভি কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং গ্রীড সোলার সিস্টেম নার্স মনিটরিং সিস্টেম ডিঙ্কিং ওয়াটার পিউরিফায়ার সিস্টেম; একই অর্থবছরে ৫,৯৫,৮০,০০০ টাকা চুক্তিমূল্যে মেডিকেল ওয়াস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম; ৫,৩৬,১৬,৪৭৪ টাকা চুক্তিমূল্যে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি), ৫,৯৪,৪৩,৯৮০ টাকা চুক্তিমূল্যে ডিস্ট্রিবিউশন লাইনসহ মেডিকেল গ্যাস সিস্টেম সরবারহ ও স্থাপণ; ৩,১৪,১৯,৫১৩ টাকা চুক্তিমূল্যে ফায়ার ফাইটিং ম্যানেজমেন্ট সিষ্টেম সরবরাহ ও স্থাপন কাজ।
এছাড়াও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১০,৮৮,৯৮,৮৮৪ টাকা চুক্তিমূল্যে ২টি ১৫০০ কেভি সাবস্টেশন এইচটি এলটি সার্ভিস ক্যাবল ৫০০ কেভি জেনারেটর ও পাম্প মোটর সেট সরবরাহ কাজগুলোতে মালামাল সরবরাহ দেখিয়ে ঠিকাদারদের পুরো বিল পরিশোধ করে প্রায় ২ কোটি টাকা লোপাট করেছেন প্রকৌশলী ফয়সাল আলম। অথচ এ সকল মালামাল নির্দিষ্ট সাইটে স্থাপণের প্রয়োজনীয় জায়গার সংকুলান হয়নি এখনও। চাইনিজ ব্র্যান্ডের মালামাল সরবরাহ নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে ডিভিশনটির প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে।
বরিশালে নভোথিয়েটার স্থাপণ প্রকল্পে ভবন নির্মাণের কাজ অর্ধেক শেষ না হলেও শূধুমাত্র কোটি টাকা লোপাটের উদ্দেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬,২১,৭৭,৪৫২ টাকা চুক্তিমূল্যে ফিডার ক্যাবলসহ ২০০০ কেভিএ সাবষ্টেশন ৪০০ কেভি জেনারেটর ৪০০ কেভি সাবস্টেশন ১৫০ কেভি জেনারেটর; ১১,৪৯,৯৯,০০০ টাকা চুক্তিমূল্যে এসি সরবরাহ ও স্থাপন ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশ্লিষ্ট কাজসহ পাম্প মোটর সেট পিএবিএক্স ও ইন্টারকম সিস্টেম সাউন্ড/পিএ কনফারেন্স সিস্টেম অডিটোরিয়াম সাউন্ড সিস্টেম স্টেজ লাইট ও ভিডিও ওয়াল অডিটোরিয়াম স্টেজ কারটেইন সরবরাহ ও স্থাপণ কাজগুলোর সকল মালামাল সরবরাহ দেখিয়ে ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এখানেও নিম্নমাণের মালামাল সরবরাহ করার অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বকয়েক কোটি টাকা বরাদ্দে দুর্গাসাগর ট্যুরিজম ফ্যাসালিটিজ প্রকল্প, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১,৪৭,৮২,৭৭০ টাকা চুক্তিমূল্যে সার্কিট হাউজ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১,০৭,৯৫,০৩২ টাকা চুক্তিমূল্যে জেলা প্রশাকের বাসভবনে বিভিন্ন ধরণের মেরামত পুণর্বাসন কাজে ওভার ইষ্টিমেটের মাধ্যমে ৩ থেকে ৪ গুণ বেশী বরাদ্দ করে অর্থ লোপাট করা হয়েছে বলে জানাগেছে।